বিসিএস ভাইভা প্রস্তুতি
আমার আগের একটি পোস্টে বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ একটি গতিশীল বিষয়। শুধু ইতিহাসের খুঁটিনাটি তথ্য মানেই মুক্তিযুদ্ধ নয়। বিশেষত ‘জেনোসাইড’ বিষয়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে তরুণ ক্যাডার কর্মকর্তাদের কাজ করার সুযোগ আছে, সুযোগ আছে দেশের স্বাধীনতা তথা গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার। সেটি হলো- পাকিস্তানের কাছে উত্তরসূরী রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাওনা আদায় ও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রচেষ্টা।
বিসিএস ভাইভায় এই প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হতে পারে, বিশেষত পররাষ্ট্র ক্যাডার প্রত্যাশীদের জন্য,যে- পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায় ও ক্ষতিপূরণ পেতে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিন।
ভূখন্ডগত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকার বলে। ভূখন্ডের উপর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাবে হতে পারে।
যেমন রাজনৈতিক নিষ্পত্তি, স্বেচ্ছা একত্রীকরণ , ভূখন্ডের স্থানান্তর , স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীনতা অর্জন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ভূখন্ড অর্জন করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার রাষ্ট্রের সব সুবিধা ও পাওনা অর্জনের অধিকারী।
যুদ্ধের পরপরই ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যক্রম পরিচালনাকারী হিসাব অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১.২ নিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশ সরকারি হিসেবে ১২৪৯ কোটি টাকা ছিলো ১৯৭২-১৯৭৩ সালে।
এরপরেও নানা ভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের দাবি প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ যে পাকিস্তানের উত্তরসূরী রাষ্ট্র , এবং উত্তরসূরী রাষ্ট্রের অধিকার নিয়ে দুটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
১) Vienna Convention on Succession of States in respect of Treaties 1978 https://drive.google.com/file/d/116eoNnudZQxAvFjU14aBWVSA14hwCSmv/view?usp=sharing
২) Vienna Convention on Succession of States in respect of State Property, Archives and Debts 1983 https://drive.google.com/file/d/11Ah5NwlTV1szMwInHn2Sm2ta2V8Bcywf/view?usp=sharing
১৯৮৩ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ১৫ নং আর্টিকেলে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে সম্পদ বন্টনের অংশীদার হবে, সেটা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ৪টি পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ নির্ণয় করে পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া কয়েকরকম ভাবে হতে পারে। তবে কোনটিকে শতভাগ সফল দাবি করার অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে যে কোন প্রক্রিয়াই ব্যর্থতার মুখ দেখতে পারে।
১ম প্রক্রিয়া
কোনরকম বাধ্যতামূলক আইনের বাইরে থেকে দ্বিপক্ষীয় দিক থেকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সমাধান করা।
উদাহরণ- গ্রিস ও পোল্যান্ড ২য় বিশ্বযুদ্ধে Compensation for War Damage to American Property in Allied Country 1947 নীতিমালার আওতায় যুদ্ধের কিছু ক্ষতিপুরণ পায়।
২য় প্রক্রিয়া
যদি এটাকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলেও চালানোর চেষ্টা করে পাকিস্তান, যা আসলে ধোপে টেকে না, সেক্ষেত্রেও বাংলাদেশ – চেকোস্লোভাকিয়া,যুগোস্লাভিয়া ও বার্মার উদাহরণ টেনে আনতে পারে। যারা ২য় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে War Damage Commission এর কাছে নিজেদের ক্ষতিপুরণ দাবি করে।
৩য় প্রক্রিয়া
নরওয়ে ও ডেনমার্ক পুরোপুরি আইনি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্ষতিপূরণের দাবি তোলে।
নরওয়ে- July 10,1946 আইন অনুযায়ী স্থাপনা ধ্বংস,
April 25, 1947, Law No. 3 অনুযায়ী স্থানান্তর যোগ্য সম্পদ ধ্বংসের ক্ষতিপুরণ
Law 475, October 1, 1945 অনুযায়ী নাগরিকের প্রাণহানি, কারাগারে প্রেরণ, বহিষ্কার, শারীরিক ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে।
এছাড়া International humanitarian law and the protection of war victims এর ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে বাংলাদেশ।
পাশাপাশি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নানা ঔপনিবেশিক বৈষম্য ও সম্পদের অসমবন্টন নিয়েও বাংলাদেশ তার প্রাপ্য দাবির কথা তুলতে পারে।
এখানে আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য, ১৯৮৩ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ৩৮নং আর্টিকেল অনুযায়ী- "উত্তরাধিকার রাষ্ট্র কোন চুক্তি ছাড়া পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের কোন ঋণ বহন করতে বাধ্য নয়। "
অথচ বাংলাদেশ পাকিস্তান আমলে নেয়া ঋণের মধ্যে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় গ্রহণ করে।
তাও কোন রকম চুক্তি ছাড়াই। এতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হলেও, পাকিস্তানের সে রকম কোন তাড়া নেই।
অবশ্য থাকার কথাও না….. নিজ দেশের দৈনন্দিন আমদানি খরচ চালাতে না পেরে একের পর এক ঋণ নিয়ে টিকে আছে যে দেশ, তার কাছ থেকে টাকা আদায় দুঃসাধ্যই বটে।
বিঃদ্রঃ- আমি ভাইভার উপযোগী করে লেখার চেষ্টা করেছি। এ নিয়ে বিশদ পড়াশোনার সুযোগ আছে। ভুল্ভ্রান্তি থাকলে উল্লেখ করবেন। সাদরে গ্রহণ করবো।
এস,এম, নুরুন্নবী
সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সুপারিশপ্রাপ্ত)
৩৮তম বিসিএস প্রশাসন